লন্ডন : শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০১:৩১ অপরাহ্ন

বায়তুল মুকাদ্দাস

বায়তুল মুকাদ্দাস

বায়তুল মুকাদ্দাস


প্রকাশ: ৩১/১০/২০২৫ ১২:০১:০০ AM

আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমাবার। আজকের বিষয় ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’। শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘ইসলাম বিভাগ প্রধান’ ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।

বায়তুল মুকাদ্দাসের ইতিহাস প্রায় হাজার হাজার বছরের পুরনো, যা হযরত আদম (আ.)-এর নির্মাণ এবং পরবর্তীতে হযরত ইবরাহীম (আ.) দ্বারা সম্প্রসারণের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। এটি পরবর্তীতে বিভিন্ন নবী যেমন ইয়াকুব (আ.) এবং সুলাইমান (আ.) দ্বারা পুনর্নির্মিত হয় এবং এটি মুসলমানদের প্রথম কিবলা ছিল।


ইসলামের ইতিহাসে এই স্থানটি মেরাজ সংঘটিত হওয়ার কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি জেরুজালেম শহরে অবস্থিত মসজিদুল আকসা, আল-কুদস, আল-আকসা মসজিদ বা বায়তুল মুকাদ্দাস। ঐতিহাসিক এই মসজিদ পবিত্র নগরী জেরুজালেমে অবস্থিত।


পবিত্র স্থাপনা
মসজিদে আকসা ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থাপনা। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, মহানবী (স.) বর্ণনা করেন, ‘তোমরা তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্যকোনো মসজিদে বিশেষ সওয়াবের উদ্দেশ্যে পরিভ্রমণ করো না। আর সে তিনটি মসজিদ হলো— মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদুল আকসা।’ (সহিহ বুখারি: ১১১৫)


নবীদের যুগে আল আকসা
আধুনিক গবেষকরা হজরত আদম আলাইহিস সালামকে এই মসজিদের প্রথম নির্মাতা বলে মতামত দিয়েছেন। নূহ আলাইহিস সালামের মহাপ্লাবনে ধ্বংস হওয়ার পরে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এর পুনঃনির্মাণ করেন।


পরবর্তীতে তার বংশধররা এই মসজিদের পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করেন। কালের পরিক্রমায় হজরত মুসা আলাইহিস সালামেরসহ অনেক নবী এই মসজিদের সংস্কার কাজ কাজ করেন। হজরত দাউদ ও সুলাইমান আলাইহিস সালামের সময় পর্যন্ত অনেক সংযোজনের মধ্য দিয়ে মসজিদুল আকসা বিস্তৃত কম্পাউন্ডে রূপান্তরিত হয়।


কিবলা
মানবজাতির প্রথমে কিবলা ‘কাবা’ শরিফ হলেও মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণের পর এটি কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রিয়নবী (স.) ওহি লাভ ও নবুয়ত প্রকাশের সময় বায়তুল মুকাদ্দাসই কিবলা ছিল।


নবীজি (স.) মদিনায় হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এ কিবলা পরিবর্তন হয়ে পুনরায় ‘কাবা’ কিবলা হিসেবে পুনর্নির্ধারিত হয়। এর সাক্ষী হিসেবে মদিনা শরিফে ‘মসজিদু কিবলাতাইন’ বা দুই কিবলার মসজিদ এখনো বিদ্যমান রয়েছে। ঐতিহাসিক এ ঘটনাকে ‘তাহবিলে কিবলা’ বা কিবলা পরিবর্তন বলা হয়। (সুরা বাকারা: ১৪২-১৫১)


আল-আকসা মসজিদ ও আশেপাশের স্থাপনা
বর্তমানে ‘আল-আকসা’ মসজিদ বলতে বোঝায় কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদ এ তিনটির সমন্বয়; যা ‘হারাম আশ শরিফ’ এর চার দেয়ালের মধ্যেই অবস্থিত। হারাম আশ শরিফ হলো- মসজিদে আকসার সঙ্গে একই প্রাঙ্গণে কুব্বাত আস সাখরা, কুব্বাত আস সিলসিলা ও কুব্বাত আন নবী নামক স্থাপনাগুলো। এসব স্থাপনাসহ এই পুরো স্থানটিকে হারাম আশ শরিফ বলা হয়।


এছাড়াও এটি বিশ্বের কাছে ‘টেম্পল মাউন্ট’ বলে পরিচিতি পেয়েছে। প্রাচীন মসজিদ আল-আকসা
পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর নির্মিত হয় আল আকসা। তাই এটিই মক্কার পর পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম নগরী। বর্তমান পৃথিবীর কোনো প্রতিষ্ঠান একে ওল্ড সিটি ঘোষণার অনেক আগেই নবীজি (স.) একে ওল্ড সিটি বা প্রাচীনতম শহরের মর্যাদা দিয়ে গেছেন।


হযরত আবুজর গিফারি (রা.) বলেন, ‘আমি নবীজি (সা.)-কে প্রশ্ন করলাম—হে আল্লাহর রাসুল (স.)! দুনিয়াতে কোন মসজিদটি প্রথম নির্মিত হয়েছে? তিনি বলেন, মসজিদুল হারাম। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, তারপর হলো মসজিদুল আকসা। অতঃপর আমি জানতে চাইলাম যে, উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? তিনি বললেন চল্লিশ বছরের। (সহিহ বুখারি: ৩১১৫)


উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী মসজিদ আল আকসার স্হাপত্য, গম্বুজ ও মিনারের তথ্য নি¤েœ তুলে ধরা হলো- স্থাপত্য : আয়াতাকার আল-আকসা মসজিদ ও এর পরিপার্শ্ব মিলিয়ে আকার ১,৪৪,০০০ বর্গমিটার (১৫,৫০,০০০ ফু২), তবে শুধু মসজিদের আকার প্রায় ৩৫,০০০ বর্গমিটার (৩,৮০,০০০ ফু২) এবং ৫,০০০ মুসল্লি ধারণ করতে পারে। মসজিদ ৮৩ মি (২৭২ ফু) দীর্ঘ, ৫৬ মি (১৮৪ ফু) প্রশস্ত সম্মুখবর্তী কুব্বাত আস সাখরায় ধ্রুপদি বাইজেন্টাইন স্থাপত্য দেখা গেলেও মসজিদুল আকসায় প্রথম দিককার ইসলামি স্থাপত্য দেখা যায়।


গম্বুজ : আবদুল মালিকের নির্মিত গম্বুজ বর্তমানে নেই। বর্তমান গম্বুজটি আজ-জাহির নির্মাণ করেছিলেন এবং এটি সীসার এনামেলওয়ার্ক আচ্ছাদিত কাঠ দ্বারা নির্মিত। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে কংক্রিটে গম্বুজ পুনর্গঠিত হয় এবং সীসার এনামেলওয়ার্কের পরিবর্তে এনোডাইজড অ্যালুমিনিয়াম দ্বারা আচ্ছাদিত হয়। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে আজ-জাহিরের সময়কারমূল নকশা ফিরিয়ে আনার জন্য এলুমিনিয়ামের কভারের বদলে পুনরায় সীসা স্থাপন করা হয়।


উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে মিহরাবের সম্মুখে নির্মিত গম্বুজগুলোর মধ্যে টিকে রয়েছে এমন কয়েকটি গম্বুজের মধ্যে আল-আকসার গম্বুজ অন্যতম। অন্যগুলো হল দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ (৭১৫) এবং সুসার জামে মসজিদ (৮৫০)। গম্বুজের ভেতরে ১৪শ শতাব্দীর অলংকরণ রয়েছে। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের অগ্নিকাণ্ডের সময় এসকল অলংকরণ চিরতরে হারিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়েছিল কিন্তু ট্রাটেজিও প্রক্রিয়ায় তা ফিরিয়ে আনা হয়।


মিনার: ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত আল-ফাখারিয়া মিনার আল-আকসা মসজিদের চারটি মিনারের মধ্যে প্রথম নির্মিত হয়। দক্ষিণ, উত্তর ও পশ্চিম পাশে মোট চারটি মিনার রয়েছে। প্রথম মিনারটি আল-ফাখারিয়া মিনার নামে পরিচিত যা ১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণপশ্চিম অংশে নির্মিত হয়। মামলুক সুলতান লাজিন এটি নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন।


এটি নির্মাণের তত্ত্বাবধায়ক আল-দিন আবদুর রহমানের বাবা ফখরউদ্দিন আল-খলিলির নামে নামকরণ করা হয়েছে। প্রথাগত সিরিয়ান শৈলীতে এটি নির্মিত হয়। এর ভিত্তি ও উলম্ব অংশ বর্গাকার এবং এটি তিনতলা বিশিষ্ট। মুয়াজ্জিনের বারান্দা দুই লাইন বিশিষ্ট মুকারনাস দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়েছে। কুলুংগি ঘিরে রয়েছে একটি বর্গাকার অংশ যা একটি সিসা আচ্ছাদিত পাথরের গম্বুজে শেষ হয়।


পরিশেষে বলব, মসজিদ আল আকসা মুসলমানদের পূর্ণ্যভূমি। এ পূর্ণ্যভূমি রক্ষাকরা ঈমানদের কর্তব্য। ইনশা আল্লাহ! শত সহস্র প্রতিকুলতার পরেও ইকদিন আল আকসা মুসলমানদের অধীনেই হবে।



আরও পড়ুন